ভূগোলবিদরা বিভিন্নভাবে শহর ও নগরের শ্রেণিবিভাগের চেষ্টা করেছেন। বিভিন্ন শহর ও নগরের মধ্যে আয়তন, , গঠন, জনসমষ্ঠির বৈশিষ্ট্য, কার্যকলাপ ইত্যাদি ক্ষেত্রে যথেষ্ট পার্থক্য রয়েছে। এসব বিষয়ে পার্থক্য থাকলেও পৌর বসতির বা নগর বসতির শ্রেণিবিভাগের ক্ষেত্রে সর্বাপেক্ষা গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে তাদের কার্যকলাপের উপর। তাই কার্যকলাপের প্রকৃতিভেদে নগর বসতিগুলোকে বিভিন্ন শ্রেণিতে বিভক্ত করা যায় :
(১) সামরিক কার্যকলাপভিত্তিক নগর : প্রতিরক্ষার প্রয়োজনে প্রতিটি দেশের গুরুত্বপূর্ণ স্থানসমূহে সামরিক ও নৌ ঘাঁটির দুর্গসমূহ গড়ে ওঠে। এই সকল স্থানকে আশ্রয় করে কালক্রমে নগর বিকাশ লাভ করে। স্কটল্যান্ডের এডিনবরা, ফ্রান্সের লা-হাভার, রাশিয়ার পিটার্সবার্গ, স্পেনের জিব্রাল্টার, ভারতের আগ্রা, গোয়ালিয়র প্রভৃতি সামরিক ঘাঁটির নগর ।
(২) প্রশাসনিক নগর : প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের মূল কেন্দ্র হলো নগর। শাসন ব্যবস্থার প্রয়োজনে সাধারণত কোনো কেন্দ্রীয় শহরকে রাজধানীর রূপ দেওয়া হয় এবং সেখানে পৌর বসতির প্রসার ঘটে। বাংলাদেশের ঢাকা, ভারতের নয়াদিল্লি, পাকিস্তানের ইসলামাবাদ, অস্ট্রেলিয়ার ক্যানবেরা প্রভৃতি প্রশাসনিক নগর।
(৩) শিল্পভিত্তিক নগর : নগরায়ণের ক্ষেত্রে শিল্পভিত্তিক কার্যকলাপ একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। শিল্পকার্য নতুন শহরের জন্ম দিলেও সাধারণত স্থায়ী শহর বা নগরের প্রতি শিল্পের আকর্ষণ অধিক হয়ে থাকে। শিল্পে শক্তি হিসেবে কয়লার ব্যবহার ব্যাপকভাবে শুরু হওয়ার পর কয়লা উত্তোলনকে কেন্দ্র করে পৃথিবীর অনেক দেশে কয়লা নগরী গড়ে উঠেছে। যুক্তরাজ্যের নিউ ক্যাসল, ভারতের রানীগঞ্জ, যুক্তরাষ্ট্রের পেনসিলভানিয়া ও রাশিয়ার ডোনেৎস অঞ্চলের নগরীসমূহ এইরূপ খনি শহর ।
(৪) বাণিজ্যভিত্তিক নগর : ক্ষুদ্র বিনিময় কেন্দ্র সম্প্রসারিত হয়ে পৌর বসতিতে রূপান্তরিত হয়। সভ্যতার আদি পর্ব হতে বিভিন্ন সমাজের মধ্যে দ্রব্য বিনিময়ের প্রথা চালু হয় এবং এই বিনিময়কে কেন্দ্র করে একটি বাজার সৃষ্টি হয়। এই সকল স্থানীয় বাজার বিভিন্ন দিক থেকে আগত পথের মিলনস্থলে গড়ে ওঠে। শহর ও নগর বিকাশের ক্ষেত্রে এর প্রভাব আজও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মহাদেশীয় স্থলপথকে অবলম্বন করে প্রাচীনকালে সিরিয়ার দামেস্ক ও আলেপ্পো, মিসরের আলেকজান্দ্রিয়া এবং মরক্কোর ফেজ শহর গড়ে ওঠে। একইভাবে বাংলাদেশের বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে ঢাকা ও কর্ণফুলী নদীর তীরে চট্টগ্রাম শহর গড়ে উঠেছে।
(৫) সাংস্কৃতিক কার্যকলাপভিত্তিক নগর : ধর্মীয় কারণে শহর বা নগরের পত্তন দেখা যায়। কোনো মহাপুরুষের জন্মস্থান বা সমাধি স্থানকে অবলম্বন করে একটি স্থায়ী পৌর বসতির বিকাশ ঘটতে পারে। মক্কা, মদিনা, জেরুজালেম, আজমীর, গয়া, বারানসী প্রভৃতি এরূপ ধর্মীয় কারণ ভিত্তিক শহর। বিখ্যাত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান যেমন, বিশ্ববিদ্যালয়, গবেষণাপ্রতিষ্ঠান প্রভৃতি কোনো স্থানে স্থাপিত হলে সেখানে পৌর বসতির বিকাশ ঘটে। প্রাচীন ভারতের নালন্দা, ব্রিটেনের অক্সফোর্ড ও ক্যামব্রিজ, ইতালির পিসা নগরী প্রভৃতি বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রিক নগর।
অন্যান্য সাংস্কৃতিক কার্যকলাপ যেমন— চিত্রকলা ও চলচ্চিত্র শিল্প ইত্যাদির উপর ভিত্তি করে নগর গড়ে ওঠে। ফ্রান্সের প্যারিস চিত্রকলা, ভারতের মুম্বাই ও আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের হলিউড চলচ্চিত্রের জন্য বিখ্যাত।
(৬) স্বাস্থ্য নিবাস ও বিনোদনের কেন্দ্র : কর্মক্লান্ত মানুষের ক্লান্তি দূর ও অবসর বিনোদনের জন্য সাধারণত শহর বা নগরের কোলাহলের বাইরে সমুদ্রসৈকত বা শৈল নিবাসে স্বাস্থ্য ও প্রমোদ কেন্দ্র গড়ে ওঠে। যেমন— বাংলাদেশের কক্সবাজার, ভারতের পুরী এবং যুক্তরাষ্ট্রের মিয়ামী ও হনলুলু সমুদ্রসৈকত কেন্দ্ৰিক বিনোদন কেন্দ্র গড়ে উঠেছে।
কাজ : বাংলাদেশের ৫টি নগর উল্লেখ করে গড়ে ওঠার কারণ চিহ্নিত কর।